আজীবন বিপ্লব ও স্বাধীনতা সংগ্রাম তারকনাথ ঘোষ

Satkhira Update: ← নতুন পৃষ্ঠা: কলারোয়া উপজেলার পূর্বাংশে ব্রিটিশ আমলে , যে কয়জন গ্রাজুয়েট ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন তাদের মধ্যে তারক নাথ ঘোষ অন্যতম । তিনি বাঙালির…


কলারোয়া উপজেলার পূর্বাংশে ব্রিটিশ আমলে , যে কয়জন গ্রাজুয়েট ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন তাদের মধ্যে তারক নাথ ঘোষ অন্যতম । তিনি বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামে ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন । ১৯৭১ সালে কলারোয়া সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন । তারক নাথ ঘোষ কলারোয়া উপজেলাধীন বামনখালী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯১৫ সালের ১২ এপ্রিল জন্মগ্রহন করেন । তার পিতার নাম অন্নন্দা প্রসাদ ঘোষ । তারক বাবুর শৈশব ও কৈশোর জীবন বামনখালি গ্রামেই কাটে । ১৯২০ সালে ৬ বছর বয়সে তাকে বামন খালি দারিকা নাথ মিডিল ইংলিশ স্কুলে ভর্তি করা হয় । এখান থেকেই ৬ষ্ঠ শ্রেণী উত্তীর্ণ হওয়ার পরে ১৯২৭ সালে তৎকালীন নড়াইলের লক্ষীপাশা হাইস্কুলে ৭ ম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয় । এই স্কুলে তিনি দশম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন । তারক বাবু ১৯২৯ সালে নমব শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন কংগ্রেস এর যশোর জেলা কমিটির সভাপতি বিজয় রায় এবং কংগ্রেস নেতা পদ্মবিলার বিজয় চ্যাটার্জীর সংস্পর্শে আসেন । এখান থেকেই তিনি পরাধীন ভারত বর্ষ স্বাধীন করার দৃঢ় শপথ গ্রহন করেন এবং সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন । একই সময়ে তারক বাবু সর্বভারতীয় কংগ্রেস পাটির ডাকে বিট্রিশ খাজনা আইন অমান্য আন্দোলন ( স্টপ রেভিনিউ মুভমেন্ট ) এ সক্রিয় অংশ নেওয়ায় ১৯৩২ সালে গ্রেফতার করে যশোর জেলে কারাবন্দী করা হয়। কয়েকদিন পর স্কুলের ছাত্র বিবেচনা করে সরকার জেল থেকে তাকে মুক্তি দেয় । জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তারক বাবু আবার জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন । বিট্রিশ পুলিশ প্রশাসন তারক ঘোষের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারী করলে তিনি আত্মগোপন করেন । পুলিশের চোখ এড়িয়ে চলার জন্য তিনি কলারোয়াতে ফিরে আসেন । অভিভাবকরা তাকে কলারোয়া জিকেএমকে পাইলট স্কুলে দশম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন । এবং এই স্কুল থেকেই তিনি কৃতিত্বের সহিত মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। মেট্রিকুলেশন পাশ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি কলিকাতা গমন করেন এবং ” চার্জ স্কটিশ কলেজ ” এ ভর্তি হন এবং এখান থেকে ১৯৪২ সালে আইএ এবং ১৯৪৫ সালে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন । কলিকাতায় ছাত্র অবস্থায় শ্রমিক নেতা সাতক্ষীরার ভাদড়া গ্রামের ফনি ঘোষ, কলিকাতার প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা সরোজিনী নাইডু এবং ভূপেশ গুপ্তের সংস্পর্শে আসেন এবং বিট্রিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয় হন । ১৯৪৩ সালে কলিকাতার সোদপুরে গান্ধিজীর আগমনকে কেন্দ্র করে প্রচার ও পিকেটিং করার সময় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন । গ্রেফতার করে তারক বাবুকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয় । একই সময়ে ডিটেনশন সেলে মাওলানা নওশের আলীর সঙ্গে একই সেলে অবস্থান করেন । তারক বাবু , মাওলানা সাহেবের নিকট থেকে আরবী ও ফার্সী ভাষা শিক্ষা নেন । জেলে থাকাবস্থায় পবিত্র কোরান পাঠ শেষ করেন । মাওলানা নওশের আলী তখন যশোর পৌর সভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও কংগ্রেস কর্মী ছিলেন । জেলখানায় বসে মাওলানা সাহেব চরকায় সুতা কাটতেন । তিনি সারাজীবন স্বদেশী ছিলেন । জেল থেকে বের হয়ে কংগ্রেস পার্টির নির্দেশে জেল খানার সঙ্গে সার্বক্ষনিক লিয়াজো রক্ষার জন্য জেলখানার ঠিকাদারী গ্রহন করেন । এই সুযোগে জেলখানার সংবাদ নেতাদের কাছে এবং নেতাদের নির্দেশ জেলখানায় অতি গোপনে পৌছে দিতেন । তারক বাবু স্কটিশ কলেজে ছাত্র অবস্থায় মাষ্টার দা সূর্যসেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, একে ফজলুল হক এবং শেখ মুজিবরের সঙ্গে পরিচয় ও ঘণিষ্ঠতা লাভ করেন । ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে তারক ঘোষ কলিকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন । ১৯৫১ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । ১৯৫০ সালে ভারত সংকার কংগ্রেস পার্টির ক্ষতিগ্রস্ত ( নিহত , আহত , দ্বীপান্তর , জেলখাটা ) , কর্মীদের তালিকা তৈরী করে রাষ্ট্রিয়ভাবে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে । ইতোমধ্যে পার্টির অনেক নেতাকর্মী ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ক্ষুধা , জরা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার আগেই মারা যান ও শোচনীয় মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হয়ে পড়েন । এ কারনে তারক ঘোষ প্রতিবাদ স্বরুপ ভারত সরকার এর দেয়া বিশেষ মর্যাদা সূচক তাম্র পাত্র ও মাসিক সম্মানী ভাতা প্রত্যাখান করে তৎকালীন ভারতের প্রধান মন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর নিকট স্বহস্তে ফেরত দেন ।
আর কখনো তিনি এই সম্মান গ্রহন করেন নাই। তৎকালীন ভারতের বহু বড় মাপের নেতা কর্মীরা তার এ প্রতিবাদ ও প্রত্যাখান এর ঘটনায় তাকে অর্থাৎ তারক ঘোষকে একজন প্রতিবাদী মানুষ এবং বড় মাপের ত্যাগী নেতা বলে স্বীকার করতে বাধ্য হন । এই সময়ে সরকারের সাহায্য না পেয়ে তৎকালীন ভারতের বহু বড় মাপের নেতা কর্মীরা তার এ প্রতিবাদ ও প্রত্যাখান এর ঘটনায় তাকে অর্থাৎ তারক ঘোষকে একজন প্রতিবাদী মানুষ এবং বড় মাপের ত্যাগী নেতা বলে স্বীকার করতে বাধ্য হন । এই সময়ে সরকারের সাহায্য না পেয়ে যে সমস্ত পার্টি কর্মী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তাদের মধ্যে পূর্ব বাংলার মধ্যে খুলনার কাঙ্গালদা, খুলনার বংশীধর সরকার , যশোর পদ্মবিলার বিজয় চ্যাটার্জী অন্যতম এরা সবাই আর্থিক অনটনে ধুকে ধুকে মারা যান।১৯৬৫ সালে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার সময় তারক বাবু ভারত ত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন । এবং নিজ বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন । ১৯৬৬ সালে আ’লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষনা করেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে ৬ দফার আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে তারক ঘোষ পূর্ব পাকিস্তান আ’লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন।১৯৭০ সালের নির্বাচনে আ’লীগের পক্ষে ব্যাপকভিত্তিক ব্যাপকভিত্তিক প্রচারনা চালান । ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে কলারোয়া থানার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সম্মানিত সদস্য নির্বাচিত হন । ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল শুক্রবার শ্রীপতিপুর পাল পাড়ায় স্থানীয় জামাত , মুসলিমলীগ নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় গণ হত্যা চালানোর পর বামনখালী গ্রামের ঘোষ পাড়ায় ঢুকে প্রথমে খগেন্দ্রনাথ ঘোষ ও রাজকুমার ঘোষকে গুলি করে হত্যা করে । ঐ একই দিনে তারক নাথ ঘোষের বাড়িটি ৩ ইঞ্চি মটারের সেলের আঘাতে উড়িয়ে দেওয়া হয়।
বামনখালি হিন্দু পাড়ায় ব্যাপকভাবে নারী নির্যাতন ও লুটতরাজ চালানো হয় । এ ঘটনার পরদিন নিহত রাজকুমার ঘোষ ও খগেন্দ্রনাথ ঘোষকে স্থানীয় জাহারমারী বিলের পাশে গণ সমাহিত করা হয় ।
ঐ একই দিনে তারক ঘোষ আত্মগোপন করে জীবনে বেচে যান । গভীর রাতের অন্ধকারে ভারতে আশ্রয় নেন । তারক বাবু মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দীর্ঘ নয় মাস নিরলস পরিশ্রম করেন । মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে প্রথমে যশোর পদ্মবিলায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পরে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তত্তাবধানে পরিচালিত রিলিফ ওয়েল ফেয়ার টীম এর কেন্দ্রীয় সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । এই টীমের প্রধান ছিলেন ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় ডেপুটি সেক্রেটারি শরদেন্দু নারায়ন ঘোষ। এই টীমের প্রধান কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও শরনার্থীদের চিকিৎসা সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধা প্রদান করা ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর কলারোয়া হানাদার মুক্ত হওয়ার কয়েকদিন পর তিনি স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন । ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাজনৈতিক গ্রেফতার শুরু হলে কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অস্ত্র উদ্ধারের নামে তারক ঘোষ কে গ্রেফতার করে অমানুষিক শারিরিক নির্যাতন চালিয়ে ডিটেনশন প্রদান করে । ২ বছর ৪ মাস তারক ঘোষকে বিনা বিচারে আটক রাখা হয় । অসুস্থ্য অবস্থায় জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি নিজ বাড়িতে অরাজনৈতিক ভাবে বসবাস শুরু করেন । সারা জীবন স্পষ্টবাদী , সৎ নির্লোভ ও বিপ্লবী তারক নাথ ঘোষ পরবর্তীকালে মরাত্মক অসুস্থ্য ও বয়স্কের ভারে ন্যুজ্জ অবস্থায় বামনখালী নিজ গৃহে অবস্থান করে, বসবাসরত অবস্থায় ১০ ই জুলাই ২০১০ তারিখে পরলোকগমন করেন।

Posted

in

by

Tags: